আর দশটা মেয়ের মতো আশা আহমেদেরও (ছদ্মনাম) নানা স্বপ্ন ছিল জীবন নিয়ে। পড়ালেখা শেষে বিয়েও করেছিলেন খুব ধুমধাম করেই। কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যে ধরা পড়ল ক্যানসার। তারপর?
২০০৪ সালে পড়ালখো শেষ করার পর বাসা থেকে বিয়ের কথা বলল। সেই বছরের শেষের দিকে একদিন খালার বাসায় পল্লবের (ছদ্মনাম) সঙ্গে পরিচয়। ২৭ বছর বয়সের দারুণ স্মার্ট একটা ছেলে, বিয়ের জন্য একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে এসে ঘেমে-নেয়ে একেবারে অস্থির হয়ে যেতে পারে, এটা আমার ধারণায় ছিল না। প্রথম দিন দেখা করব। আমি গিয়েছি কাজিনদের সঙ্গে; তার ওপর আমার খালার বাসা। সেদিন কথাও হয়েছিল আমাদের। ছেলেটার ভদ্রতাজ্ঞান অসাধারণ! আমার ভালো লেগেছিল। আসলে দুজনেরই ভালো লেগেছিল দুজনকে।
বাসা থেকে যখন ছেলে বা তার পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে, তত দিনে আমাদের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল। দুজন ফোনে কথা বলি, ঘুরতে যাই। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখ আমাদের পান-চিনি হয়ে গেল। আর সে মাসেরই ১৬ তারিখে আমার বাসা থেকে গেল ওকে আংটি পরাতে।
আমাদের পক্ষ থেকে বিয়েতে তারিখ ঠিক হলো ২০০৫ সালের জানুয়ারি ১৩। ওরা জানাল, ১৫ তারিখ বউভাত। সময়গুলো খুব সুন্দর ছিল। আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। আমার বিয়ে নিয়ে সবারই নানা স্বপ্ন, শখ, আবদার! যদিও আমার বাড়ি বিক্রমপুর আর বরের বাড়ি রাজশাহী, তবে বিয়ে আর বউভাত দুটোই হয়েছিল ঢাকায়। আমার ২২ বছরের জীবনে এর আগে এত সুন্দর মুহূর্ত আর ছিল না। দিনগুলো কেমন যেন উড়ে যেতে লাগল। ভালোবাসা এত সুন্দর!
২০০৪ সালে পড়ালখো শেষ করার পর বাসা থেকে বিয়ের কথা বলল। সেই বছরের শেষের দিকে একদিন খালার বাসায় পল্লবের (ছদ্মনাম) সঙ্গে পরিচয়। ২৭ বছর বয়সের দারুণ স্মার্ট একটা ছেলে, বিয়ের জন্য একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে এসে ঘেমে-নেয়ে একেবারে অস্থির হয়ে যেতে পারে, এটা আমার ধারণায় ছিল না। প্রথম দিন দেখা করব। আমি গিয়েছি কাজিনদের সঙ্গে; তার ওপর আমার খালার বাসা। সেদিন কথাও হয়েছিল আমাদের। ছেলেটার ভদ্রতাজ্ঞান অসাধারণ! আমার ভালো লেগেছিল। আসলে দুজনেরই ভালো লেগেছিল দুজনকে।
বাসা থেকে যখন ছেলে বা তার পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে, তত দিনে আমাদের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল। দুজন ফোনে কথা বলি, ঘুরতে যাই। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখ আমাদের পান-চিনি হয়ে গেল। আর সে মাসেরই ১৬ তারিখে আমার বাসা থেকে গেল ওকে আংটি পরাতে।
আমাদের পক্ষ থেকে বিয়েতে তারিখ ঠিক হলো ২০০৫ সালের জানুয়ারি ১৩। ওরা জানাল, ১৫ তারিখ বউভাত। সময়গুলো খুব সুন্দর ছিল। আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। আমার বিয়ে নিয়ে সবারই নানা স্বপ্ন, শখ, আবদার! যদিও আমার বাড়ি বিক্রমপুর আর বরের বাড়ি রাজশাহী, তবে বিয়ে আর বউভাত দুটোই হয়েছিল ঢাকায়। আমার ২২ বছরের জীবনে এর আগে এত সুন্দর মুহূর্ত আর ছিল না। দিনগুলো কেমন যেন উড়ে যেতে লাগল। ভালোবাসা এত সুন্দর!
দুঃসময়ের শুরু
বিয়ের প্রথম কয়েক মাস শুধু ঘুরে বেড়িয়ে আর স্বপ্ন দেখেই কেটে গেল। ২০০৫ সালের মাঝের দিকে একদিন ঘাড়ে কেমন যেন একটা ফোড়ার মতো উঠল। মালিবাগ রেলগেটের কাছে একটা হাসপাতালে গেলাম চিকিৎসক দেখাতে। তিনি সাত দিনের অ্যান্টিবায়োটিক দিলে সেটা খেয়েও নিলাম। তখন আমার বিয়ের মাত্র চার মাস।
জুনের ৫ তারিখ আমি প্রথমবারের মতো গেলাম শ্বশুরবাড়ি। আদর-যত্ন আর ভালোবাসায় ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো; শুধু ঘাড়ের ওই অংশ বারবার তার অস্তিত্ব জানান দেওয়া ছাড়া। কয়েক দিন যেতেই শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করল। আমি যেটাকে ফোড়া ভেবেছিলাম, সেটা ধীরে ধীরে টিউমারের রূপ নিচ্ছে। দুশ্চিন্তায় একদিকে বাবার বাড়ি অস্থির, আরেক দিকে শ্বশুরবাড়ি! পল্লবের অবস্থা তো বেশ খারাপ। মাত্র চার মাসের নতুন বউ প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে কোন ছেলেই আর স্থির থাকতে পারে?
সবাই তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দিল। ফিরেই চিকিৎসকের কাছে গেলাম। অবস্থা দেখে তিনি কিছু পরীক্ষা দিলেন। প্রথমবার টেস্টে কী এসেছিল, কেউ আমাকে বলল না; শুধু জানানো হলো, পরীক্ষা ভুল আছে। আবার করাতে হবে। বায়োপসি করালাম। এবার করালাম তিনটি হাসপাতালে। এগুলোর একটা থেকে জানানো হলো হজকিন্স লিম্ফোমা, আর দুটো নন-হজকিন্স লিম্ফোমা। লিম্ফোমা? তার মানে ক্যানসার? আমার চারপাশের সাজানো পৃথিবীটা মুহূর্তে খানখান হয়ে গেল।
ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস
বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আমাকে দেশের বাইরে নেওয়া হবে চিকিৎসার জন্য। আমার বিয়ের তখন ছয় মাসও হয়নি। পল্লবের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও। তোমার সামনে অনেক সুন্দর আর লম্বা পথ। আমি আর পারছি না।’
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাইরে যাব না। দেশেই চিকিৎসা করাব। মা কান্নাকাটি করে, বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না আটকায়। শ্বশুরবাড়ি থেকেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। আত্মীয়-বন্ধু সবাই যখন বোঝাতে ব্যর্থ হলো, পল্লব শুধু একটা কথাই বলল, ‘দেখো আশা, তুমি এখন ভাবছ আমরা চিকিৎসা করতে যাচ্ছি? মানুষ বিয়ের পর দেশের বাইরে ঘুরতে যায় না? আমরাও তাই যাচ্ছি।’
মন শক্ত করলাম। আমার মাথায় তখন যতটা চাপ, তার থেকে অনেক বেশি মনে।
২০০৫ সালের ২৩ জুলাই, বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় কলকাতার ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলাম। সম্পূর্ণ পরীক্ষা করে জানানো হলো নন-হজকিন্স লিম্ফোমা। চিকিৎসক তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমরা আপনার চিকিৎসা শুরু করতে যাচ্ছি। এতে তিন ধরনের সমস্যা হবে। প্রথমত, আপনি কোনো দিন মা হতে পারবেন না। এর পরেরটা হচ্ছে আপনার চুল, ভ্রু সব পড়ে যাবে। আর তৃতীয় সমস্যাটি একবারেই শরীরের ভেতরের পরিবর্তন। সেটা আপনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবেন।’
চিকিৎসকের রুম থেকে বের হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার সঙ্গে কাকা-কাকি আর পল্লব গেছে। আমি কেঁদে কেঁদে কাকাকে রীতিমতো রাজি করিয়ে ফেলেছি দেশে ফিরে আসার জন্য। আমার নিজের একটা সন্তান হবে না? কোমর পর্যন্ত ছড়ানো চুলগুলো আর থাকবে না? আমি করবই না এই চিকিৎসা।
শেষ পর্যন্ত এসব কান্নাকাটি ধোপে টিকল না। শুরু হলো কেমো থেরাপি। সব মিলিয়ে আমাকে আটটি কেমো দেওয়া হলো।
প্রথম কেমো দেওয়ার পর বালিশের দিকে তাকিয়ে দেখি গোছা গোছা চুল। এমন বাঙালি মেয়ে কি আছে, যে চুল ভালোবাসে না?
বিয়ের প্রথম কয়েক মাস শুধু ঘুরে বেড়িয়ে আর স্বপ্ন দেখেই কেটে গেল। ২০০৫ সালের মাঝের দিকে একদিন ঘাড়ে কেমন যেন একটা ফোড়ার মতো উঠল। মালিবাগ রেলগেটের কাছে একটা হাসপাতালে গেলাম চিকিৎসক দেখাতে। তিনি সাত দিনের অ্যান্টিবায়োটিক দিলে সেটা খেয়েও নিলাম। তখন আমার বিয়ের মাত্র চার মাস।
জুনের ৫ তারিখ আমি প্রথমবারের মতো গেলাম শ্বশুরবাড়ি। আদর-যত্ন আর ভালোবাসায় ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো; শুধু ঘাড়ের ওই অংশ বারবার তার অস্তিত্ব জানান দেওয়া ছাড়া। কয়েক দিন যেতেই শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করল। আমি যেটাকে ফোড়া ভেবেছিলাম, সেটা ধীরে ধীরে টিউমারের রূপ নিচ্ছে। দুশ্চিন্তায় একদিকে বাবার বাড়ি অস্থির, আরেক দিকে শ্বশুরবাড়ি! পল্লবের অবস্থা তো বেশ খারাপ। মাত্র চার মাসের নতুন বউ প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে কোন ছেলেই আর স্থির থাকতে পারে?
সবাই তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দিল। ফিরেই চিকিৎসকের কাছে গেলাম। অবস্থা দেখে তিনি কিছু পরীক্ষা দিলেন। প্রথমবার টেস্টে কী এসেছিল, কেউ আমাকে বলল না; শুধু জানানো হলো, পরীক্ষা ভুল আছে। আবার করাতে হবে। বায়োপসি করালাম। এবার করালাম তিনটি হাসপাতালে। এগুলোর একটা থেকে জানানো হলো হজকিন্স লিম্ফোমা, আর দুটো নন-হজকিন্স লিম্ফোমা। লিম্ফোমা? তার মানে ক্যানসার? আমার চারপাশের সাজানো পৃথিবীটা মুহূর্তে খানখান হয়ে গেল।
ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস
বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আমাকে দেশের বাইরে নেওয়া হবে চিকিৎসার জন্য। আমার বিয়ের তখন ছয় মাসও হয়নি। পল্লবের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও। তোমার সামনে অনেক সুন্দর আর লম্বা পথ। আমি আর পারছি না।’
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাইরে যাব না। দেশেই চিকিৎসা করাব। মা কান্নাকাটি করে, বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না আটকায়। শ্বশুরবাড়ি থেকেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। আত্মীয়-বন্ধু সবাই যখন বোঝাতে ব্যর্থ হলো, পল্লব শুধু একটা কথাই বলল, ‘দেখো আশা, তুমি এখন ভাবছ আমরা চিকিৎসা করতে যাচ্ছি? মানুষ বিয়ের পর দেশের বাইরে ঘুরতে যায় না? আমরাও তাই যাচ্ছি।’
মন শক্ত করলাম। আমার মাথায় তখন যতটা চাপ, তার থেকে অনেক বেশি মনে।
২০০৫ সালের ২৩ জুলাই, বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় কলকাতার ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলাম। সম্পূর্ণ পরীক্ষা করে জানানো হলো নন-হজকিন্স লিম্ফোমা। চিকিৎসক তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমরা আপনার চিকিৎসা শুরু করতে যাচ্ছি। এতে তিন ধরনের সমস্যা হবে। প্রথমত, আপনি কোনো দিন মা হতে পারবেন না। এর পরেরটা হচ্ছে আপনার চুল, ভ্রু সব পড়ে যাবে। আর তৃতীয় সমস্যাটি একবারেই শরীরের ভেতরের পরিবর্তন। সেটা আপনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবেন।’
চিকিৎসকের রুম থেকে বের হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার সঙ্গে কাকা-কাকি আর পল্লব গেছে। আমি কেঁদে কেঁদে কাকাকে রীতিমতো রাজি করিয়ে ফেলেছি দেশে ফিরে আসার জন্য। আমার নিজের একটা সন্তান হবে না? কোমর পর্যন্ত ছড়ানো চুলগুলো আর থাকবে না? আমি করবই না এই চিকিৎসা।
শেষ পর্যন্ত এসব কান্নাকাটি ধোপে টিকল না। শুরু হলো কেমো থেরাপি। সব মিলিয়ে আমাকে আটটি কেমো দেওয়া হলো।
প্রথম কেমো দেওয়ার পর বালিশের দিকে তাকিয়ে দেখি গোছা গোছা চুল। এমন বাঙালি মেয়ে কি আছে, যে চুল ভালোবাসে না?
0 comments:
Post a Comment