Md. Afrooz Zaman Khan

Afrooz
Md. Afrooz Zaman Khan. Powered by Blogger.
RSS

কিছু তরুণের গল্প শুনুন





‘ভিন্নভাবে সক্ষম’ তরুণদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য কাজ করেন স্বর্ণ ময়ী সরকার (বাঁ থেকে প্রথম)। ছবি: সংগৃহীত 

পরীক্ষায় ভালো নম্বর নয়, কিংবা নয় ভালো একটা চাকরি, দেশের অনেক তরুণই ছুটছেন আনন্দের পেছনে। কেউ সহযোগিতা করছেন সমাজের বিশেষ কিছু মানুষকে। কেউ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন পাঠাগার আন্দোলন। আবার কেউবা শুধু স্বপ্ন দেখছেন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর। ঈদের এই ছুটিতে আনন্দ-সন্ধানী এমন কিছু তরুণের গল্প শুনুন।
গল্পটা যখন আমরা শুনছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, এটা তো উপন্যাসের কাহিনি! মো. ইমাম হোসাইন নামের যে তরুণ এখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ প্রথম বর্ষে পড়ছেন, গল্পটা তাঁরই। ২০০৬ সালের কথা। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে স্কুলের ছুটিতে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ইমাম কুমিল্লা থেকে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। কাজ করে কটা টাকা আয় করবেন, এটাই ছিল আশা। ষোলশহরে একটা মেসে গাদাগাদি করে থাকতেন চার বন্ধু মিলে। কাজ করতেন ১২০ টাকা বেতনে। একসময় ধীরে ধীরে তিন বন্ধু তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন। বেতনের অল্প কটা টাকায় মেসে থাকারও উপায় নেই তখন। শেষমেশ ষোলশহর রেলজংশনের যাত্রী ছাউনি আর ট্রেনের বগিতেই রাত কাটাতে শুরু করলেন ইমাম। তারপরও তাঁকে কাজ করে যেতে হবে, উপায় নেই। একসময় আরও বেশি বেতনে আরেকটা চাকরি জুটিয়ে নিলেন। মাস শেষে হাতে যখন বেশ কিছু টাকা জমে গেল, তখন এল বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ি ফেরার আগে ইমাম কী করেছিলেন জানেন? বই কিনেছিলেন। গল্পের বই।
সেই কিশোর ইমাম সে বছর অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। এসএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ-ফাইভ। অত কিছুর পরও একটা নেশা তাঁর কখনো কাটেনি—বই পড়া। কেবল বই পড়েই বসে থাকেননি, বই জোগাড় করে বন্ধু-এলাকাবাসীকেও পড়তে দিয়েছেন। এভাবে চলতে চলতে ইমাম আজ দেশের ৪৩টি জেলায় ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘পাঠাগার আন্দোলন’। কুমিল্লা জেলায় আছে তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত ছয়টি পাঠাগার। একটি করে পাঠাগার গড়ে তুলেছেন নরসিংদী, দিনাজপুর ও চাঁদপুরে। এত যে কষ্ট করেছেন, তারপরও কেন পাঠাগার আন্দোলন বা বই পড়ার এই উদ্যোগের পেছনে লেগে ছিলেন আপনি? প্রশ্নটা শুনে ফোনের ওপাশ থেকে ইমাম বললেন, ‘বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে। বই না পড়লে তো আমরা আলোকিত হতে পারব না। কেউ যখন বই পড়ে, তখন সেটা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। শুধু ভালো রেজাল্ট করেই তো আর হয় না। মনের আনন্দের জন্য কিছু করতে হয়।’

 নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কিশোর–তরুণদের নিয়ে সমাজ সচেতনমূলক কাজ করেন কাঞ্জিলাল রায় (ইনসেটে)। ছবি: সংগৃহীত

আনন্দ তুই কোথায় থাকিস বল...
ইমামের কথা শুনে কবি আহসান হাবীবের ‘আনন্দ’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে আমাদের। ‘আনন্দ রে আনন্দ তুই কোথায় থাকিস বল...’। আনন্দ কেবল পরীক্ষার ভালো ফলেই নেই। দারুণ বেতনের একটা চাকরিতেই আনন্দ তার সীমা বেঁধে রাখতে পারেনি। তাই তো তরুণেরা প্রাত্যহিক কাজকর্মের বাইরেও অনেক কিছুই করেন। কিছু না করতে পারলেও অন্তত অনেক স্বপ্ন দেখেন। যেমন ধরা যাক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তানভীর হায়দার ও তাঁর বন্ধুদের কথা। ‘ব্রাইটার স্মাইল’ নামে একটা সংগঠন আছে তাঁদের। তানভীরের ভাষায়, ‘সেই অর্থে এখনো তেমন কিছুই করতে পারিনি।’ (তাই নিজেদের কাজের ছবি প্রকাশেও আগ্রহী নন তাঁরা)। কিন্তু কিছু একটা করবেন বলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে বন্ধুরা মিলে প্রতি মাসে প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে জমাচ্ছেন। যখন প্রশ্ন করলাম, ‘কী হবে এই টাকা দিয়ে?’ তানভীর বললেন তাঁদের স্বপ্নের কথা, ‘কিছু একটা করব এটা জানি। বিশেষ করে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আসা মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা আমাদের। এর মাঝে এই জমানো টাকা নিয়ে এক ছোট ভাইয়ের বন্ধুর মায়ের অসুস্থতার সময় পাশে দাঁড়িয়েছি। সম্প্রতি সাহায্য পাঠিয়েছি কুড়িগ্রামের বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য।’

স্বপ্নময়ী স্বর্ণ ময়ী
বন্যাদুর্গত মানুষের প্রসঙ্গে আরেকটা গল্প বলছিলেন ঢাকা সিটি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা স্বর্ণ ময়ী সরকার, ‘২০০৭ সালের কথা। তখন আমি নাটোরে ছিলাম। টিভিতে দেখছিলাম, আমাদের এলাকায় বন্যার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ দেওয়া হবে। তখনই ঠিক করি, আমিও যাব ত্রাণ দিতে। মাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ত্রাণ দিতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুকে নিয়ে। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, এমন কিছু করব যাতে মানুষের মুখে হাসি ফোটে।’ স্বর্ণ ময়ীর স্বপ্নটা দানা বাঁধতে শুরু করল যখন তিনি ঢাকায় এলেন। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেলেন নাতাশা ইশরাত কবিরকে। দুজনে মিলে গড়ে তুললেন Bridge Foundation (বাংলাদেশ রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ ফর ডেভেলপমেন্ট গভর্নেন্স অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশন)।
কী তাঁদের কাজ? স্বর্ণ ময়ীর ভাষায়, ‘ভিন্নভাবে সক্ষম তরুণদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য কাজ করি আমরা। নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিই তাঁদের। প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের প্রমাণও করছেন তাঁরা। আসলে তাঁরা সবাই প্রতিভাবান। দরকার শুধু একটু সহযোগিতা। আমরা সেটাই করছি। প্রতি শুক্রবার আমরা তাঁদের নিয়ে বসি। এটা যে কত আনন্দের, তা বলে বোঝাতে পারব না।’
এমন আনন্দের খোঁজ যারা পেতে চায়, কিন্তু সুযোগ পায় না, তাদের কী করা উচিত? স্বর্ণ ময়ী এক কথায় জবাব দিলেন, ‘ইচ্ছাটুকু লাগবে।’


‘চলো পাল্টাই’

কোন ইচ্ছা যে কখন কীভাবে হয়, এটাও বলা মুশকিল! যেমনটা হয়েছিল কাঞ্জিলাল রায় ও তাঁর বন্ধুদের বেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী কাঞ্জিলাল। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা থেকে এসেছেন তিনি। বলছিলেন বছর তিনেক আগের ইচ্ছাটার কথা, ‘আমাদের ডিমলা ইসলামিয়া কলেজের সামনে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ ক্লাস সিক্স পড়ুয়া এক ছোট ভাই এসে খুব উদ্ধত আচরণ করে বসল। তার আগেও অমনটা করেছিল সে। তখনই নাকি সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত! তাই তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, “পলিটিকসের ইংরেজি বানানটা বলো তো।” রাজনীতিবিদ ছোট ভাই নিরুত্তর। এভাবে দেখলাম, কেবল ওই ছোট ভাই-ই না, আরও অনেকেই ছোটখাটো অনেক কিছু জানে না। তাই ঠিক তখনই আমাদের মনে হলো, আমরা যে পড়াশোনা করছি, এটার মানে কী? আর এটা যদি অন্যদের বোঝাতে না পারি, তাহলে এই পড়াশোনারই-বা মানে কী?’
কঠিন প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। কঠিন প্রশ্নের সমাধানও বের করার চেষ্টা করলেন কাঞ্জিলাল ও তাঁর বন্ধুরা। এসএসসি পরীক্ষার পর হাত-পা ছড়ানো অবস্থা। সবাই মিলে লাগলেন কিশোর-তরুণদের পড়াশোনার বাইরেও আরও কিছু করার ব্যাপারে উৎসাহী করার কাজে। শুরুতে এলাকার বড়দের কেউ কেউ ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখলেন না। তারপরও দমে গেলেন না কাঞ্জিলালরা। আস্তে-ধীরে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বাল্যবিবাহবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নাট্যচর্চার মতো কাজও শুরু করে দিলেন। সংগঠনটির নাম দিলেন ‘চলো পাল্টাই’। গোটা এলাকার কিশোর-তরুণেরা নড়েচড়ে বসল। পরিবর্তনের একটা হাওয়া বয়ে গেল ভেতরে-ভেতরে। কীভাবে সেটা বুঝলেন? কাঞ্জিলালের ব্যাখ্যা, ‘আমাদের এলাকা থেকে একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিনজনের বেশি কখনো হয়নি। কিন্তু ওই কার্যক্রমগুলো শুরু হওয়ার পর চিত্রটা পাল্টে গেল। আমাদের ব্যাচ থেকেই সাতজন চান্স পেয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছাড়া অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পেয়েছিল ৩২ জন।’
বিতর্ক-নাটক-বৃক্ষরোপণ বা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে পরীক্ষার ফলের সম্পর্ক কী? কাঞ্জিলাল যেন এই প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, ‘শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়েই যে ভালো শিক্ষার্থী হওয়া যায় না; এটা অনেকেই জানেন। কিন্তু কী করলে সত্যিকারের ভালো শিক্ষার্থী হওয়া যাবে, সেটা সবাই জানেন না। আমরা বিশ্বাস করি, আপনি ভালো কাজ করলেও ২৪ ঘণ্টায় দিন হবে, খারাপ কাজ করলেও ২৪ ঘণ্টায় দিন হবে। তাই আমরা চেয়েছিলাম, এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সবাই যেন ভালো কাজ করে। ভালো কাজ করলে এমনিতেই যে কেউ ভালো শিক্ষার্থী হয়ে উঠতে পারে।’
মজার বিষয় হলো, যেসব অভিভাবক শুরুর দিকে কাঞ্জিলালদের কাজকর্ম ভালোভাবে নেননি, তাঁরাই এখন তাঁদের সন্তানদের বলেন, বড় ভাইদের মতো হও।

  • Digg
  • Del.icio.us
  • StumbleUpon
  • Reddit
  • RSS

0 comments:

Post a Comment