জীবনের পরিকল্পনা করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই দেখি, কোথায় যাচ্ছি, তা নিয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই, কিন্তু সবাই যত দ্রুত সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই। আজ হয়তো তুমি ভাবছ নতুন একটি ব্যবসা শুরু করবে, হয়তো ক্যানসারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করবে অথবা অসাধারণ কোনো উপন্যাস লিখবে। অথবা কে জানে, কোন ভুলে হয়তো সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। সাত বছর আগে আমি ভাবতেও পারিনি, আজ এখানে দাঁড়িয়ে তোমাদের সামনে বক্তৃতা দিতে হবে। অনেক ভেবে দেখেছি, আমি যদি সব আবার নতুন করে শুরু করতে পারতাম, তাহলে কী করতাম। আজ তাই আমি তোমাদের হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দিতে চাই, যা আমার সমাবর্তনের দিন কেউ আমাকে দিলে দারুণ হতো। এই চিরকুটে বেশি কিছু রাখব না আমি—একটি টেনিস বল, একটি বৃত্ত ও একটি সংখ্যা ৩০০০০। শুনতে অদ্ভুত লাগছে? বুঝিয়ে বলছি।
আমি যখন প্রথম ব্যবসা শুরু করি, তখন আমার বয়স মাত্র ২১। আমি বা আমার সহ-উদ্যোক্তা অ্যানড্রু—কারোরই এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা ছিল না। খেতে খেতে আমরা ঠিক করলাম, স্যাট (এসএটি) পরীক্ষার জন্য নতুন একধরনের অনলাইন কোর্স চালু করব। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় আমি একগাদা ব্যবসা-সংক্রান্ত বই নিয়ে ছাদে উঠে যেতাম, নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে হচ্ছিল, যেসব নিয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কয়েক বছর পর ধীরে ধীরে আমার উৎসাহ কমতে শুরু করল। আর ভালো লাগছিল না, কিছু একটা গোলমাল বুঝতে পারছিলাম। কাজের গতি কমে আসায় নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমার স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হওয়া, কিন্তু নিজের ওপর আর বিশ্বাস রাখতে পারছিলাম না। হয়তো উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যা দরকার তা আমার ভেতর একেবারেই নেই।
তাই ভাবলাম, একটা বিরতি নিয়ে দেখা যাক। আমি অনলাইনে পোকার খেলার জন্য একটি সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন বা ‘পোকার বট’ তৈরি করা শুরু করলাম। এটা আমার জন্য একটা দারুণ চ্যালেঞ্জ ছিল। হঠাৎ যেন সবকিছু বদলে গেল! আমি সারাক্ষণ এটা নিয়ে মগ্ন থাকতাম; গোসল করার সময়ই হোক আর গভীর রাত—এটা যেন আমার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। মনে হচ্ছিল, কেউ আমার ভেতর একটি সুইচ অন করে দিয়েছে—আমি যেন এক অন্য আমিতে পরিণত হয়েছি!
আমি সহজ ভাষায় বলতে পারতাম, যা ভালোবাসো, তা নিয়েই কাজ করো; কিন্তু এটি তার চেয়েও বেশি কিছু। নিজের মনকে বোঝানো কঠিন কিছু নয়—যে তোমার কাজকে তুমি ভালোবাসো। কে-ই বা তার উল্টোটা স্বীকার করতে চায়? কিন্তু আমি সবচেয়ে সুখী ও সফল যেসব মানুষকে দেখেছি, তাঁরা নিজেদের কাজকে শুধু ভালোবাসতেন না, তাঁরা কোনো একটা সমস্যা সমাধানের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। এমন কোনো সমস্যা, যা তাঁদের কাছে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, যার সঙ্গে তাঁরা নিজেদের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেন। তোমাদের পোষা কুকুর যখন কোনো ছুড়ে দেওয়া টেনিস বল লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে, তখন সেটিকে খেয়াল করে দেখো—চোখজোড়া সম্পূর্ণ বলের ওপর নিবদ্ধ, সামনে যা-ই পড়ুক না কেন, তা ডিঙিয়ে, পাশ কাটিয়ে বলটিকে সে লুফে নেবেই! সমস্যা হচ্ছে, অনেকেই তাদের ‘টেনিস বল’ চট করে খুঁজে পায় না। স্যাট পরীক্ষার অনলাইন কোর্স বানানো যে আমার অপছন্দের ছিল, তা নয়, কিন্তু সেটি আমার ভেতর টেনিস বল লুফে নেওয়ার সেই তীব্র ইচ্ছাকে জাগাতে পারেনি। অথচ সেই ‘পোকার বট’ আর আমার বর্তমান প্রতিষ্ঠান ‘ড্রপবক্স’—দুটোরই সূচনা হয়েছে খেলার ছলে, ছকবাঁধা কাজের বাইরে। মনের ভেতর একটি ক্ষীণ স্বর আমাকে বলছিল, কোথায় যেতে হবে, আর আমি সারাক্ষণ সেটিকে দমিয়ে রাখছিলাম, নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম—এখন খেলা নয়, কাজের সময়। আসলে, সেই ক্ষীণ স্বরটিই ভালো জানত, কোনটি আমার আসল কাজ হওয়া উচিত।
আমা এটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল যে সবচেয়ে পরিশ্রমী মানুষ শুধু কাজ করতে হবে বলেই কাজ করেন না। সমস্যা সমাধান করার অকল্পনীয় আনন্দ তাঁদের কাজ করার উৎসাহ জোগায়। তাই আজকের পর থেকে শুধু কাজ করার জন্য না করে কিংবা নিজের ওপর অযথা জোর না খাটিয়ে তোমার ‘টেনিস বল’টিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করো, যা তোমাকে সামনে টেনে নিয়ে যাবে। যত দিন তা না খুঁজে পাও, কান পেতে নিজের ভেতরের ক্ষীণ স্বরটি শুনতে চেষ্টা করো।
অনেকে বলে, আমরা যে পাঁচজন মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাই, তাদের গড় করলে আমাদের অবস্থান পাওয়া যাবে। একটু চিন্তা করে দেখো, তোমার এই ‘সেরা পাঁচ’-এর বৃত্তে কারা আছে। নিজের এই বৃত্ত গড়ে তোলার জন্য এমআইটি পৃথিবীর সবচেয়ে দারুণ স্থানগুলোর একটি। এখানে না এলে আমি হয়তো ‘ড্রপবক্স’ গড়ে তুলতে পারতাম না। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে প্রেরণাদায়ী, অনুসরণীয় মানুষের সান্নিধ্যে থাকা কঠোর পরিশ্রম বা প্রতিভার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তোমার চারপাশের মানুষই তোমাকে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করতে পারে, সামনের দিকে যেতে সাহায্য করতে পারে। তুমি যা-ই করো না কেন, সাধারণত সে বিষয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বরা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে আছেন। তুমিও সেখানে যাও, সহজলভ্য কোনো কিছুতে নিজেকে ভুলিয়ে রেখো না। শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তোমার চোখে সফল ব্যক্তিরাও তোমার বৃত্তেরই একটি অংশ, তাঁদের অনুসরণ করো।
অনেকে স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে তৈরি করতে করতে খুব বেশি সময় হারিয়ে ফেলে। নিজেকে অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে, কিন্তু এই তরুণ বয়সে কিছু শেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো হাতে-কলমে করা। স্বপ্ন দেখতে, পরিকল্পনা করতে, নিজেকে তৈরি করতে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়, অনেকেই তা করে। কিন্তু আসলে তোমাদের উচিত সোজা ভাষায় কাজে লেগে পড়া। আমি কখনো পুরোপুরি তৈরি হয়ে, সব শিখে কাজ শুরু করতে পারিনি। ড্রপবক্স গড়ে তুলতে গিয়ে অসংখ্য সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু আসল কথা হলো, এতে কিছুই যায় আসে না। ক্লাসের পরীক্ষার মতো জীবনের পরীক্ষায় কেউ ১০০-তে ১০০ পায় না। হ্যাঁ, পরীক্ষার খাতায় প্রতিটি লাল কালির দাগ নম্বর কমিয়ে দেয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে তুমি যদি প্রায়ই ধাক্কা না খাও, তাহলে বুঝতে হবে, তুমি যথেষ্ট দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছ না। আমি বলব, তোমাদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ব্যর্থতা নয়, বরং অতিরিক্ত নিশ্চয়তা। তুমি একবার ভালোভাবে সফল হলে সবাই সেটিই মনে রাখবে, তার আগে কত শতবার ব্যর্থ হয়েছ, তা কেউ জানতেও চাইবে না।
আমি আগে অনেক কিছু নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করতাম। তখন মাত্র সান ফ্রানসিসকোয় থাকা শুরু করেছি, একরাতে ঘুম আসছিল না দেখে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। একটা লেখায় চোখ আটকে গেল, ‘জীবনে গড়ে ৩০০০০ দিন আছে।’ প্রথমে আমি তেমন পাত্তা দিইনি, কিন্তু কী মনে হলো আমি ২৪-কে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলাম। সংখ্যাটা দেখে নিজের কাছেই অবাক লাগল—৩০০০০ দিন থেকে এর মধ্যেই প্রায় ৯০০০ দিন খরচ করে ফেলেছি! কী করলাম?
সেদিন থেকেই আমার চিরকুটে ৩০০০০ সংখ্যাটি জায়গা করে নিয়েছে। জীবনের কোনো ওয়ার্মআপ নেই, প্র্যাকটিস রাউন্ড নেই, কোনো রিসেট বাটনও নেই। প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে জীবনের গল্পে কয়েকটি শব্দ যোগ করে চলছি। তাই আমি আমার জীবনকে নিখুঁত বানানোর চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে একে যতটুকু পারি আকর্ষণীয় করে তুলছি। আমি চেয়েছিলাম আমার জীবনের গল্প একটি রোমাঞ্চ কাহিনি হয়ে উঠুক—এই সিদ্ধান্তই জীবনের অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। তাই তোমাদের উদ্দেশে আমি বলব, জীবনকে আগাগোড়া নিখুঁত, নির্ভুল করার চেষ্টা না করে একে স্বাধীনভাবে সাজিয়ে তোলো, এক রোমাঞ্চকর অভিযানে পরিণত করে সামনে এগিয়ে যাও। ধন্যবাদ।
0 comments:
Post a Comment