ফুটবল বিশ্বকাপে শাকিরা না থাকলে কি চলে? তাই তো এবারের বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানেও শাকিরা ‘লা লা’ গান দিয়ে মাতালেন পুরো বিশ্বকে। তাঁর গাওয়া ২০১০ বিশ্বকাপের অফিশিয়াল থিম সং ‘ওয়াকা ওয়াকা’ ছিল ইউটিউবে সর্বাধিক শোনা গানের অন্যতম। শাকিরার জন্ম ১৯৭৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, কলম্বিয়ায়। তাঁর ক্যারিয়ারে তিনি পেয়েছেন গ্র্যামি, গোল্ডেন গ্লোব, আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, এমটিভি মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার।
তখন শাকিরার বয়স সবে আট বছর। হঠাৎই একদিন তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ব্যবসায় ধস নামলে শাকিরার বাবা অর্থাভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন আর মেয়েকে জোর করে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর শাকিরা নিজ শহরে ফিরে এসে দেখেন তাঁদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘বাড়ি ফিরে দেখি আমাদের সব আসবাব বিক্রি করে ফেলা হয়েছে, রঙিন টিভিটা নেই। দুটো গাড়ির একটাও নেই। আমি ভীষণ ভেঙে পড়ি।’ শাকিরার গান-নাচ সব থেমে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু বড় হয়ে যিনি বিশ্ব মাতাবেন, তাঁর তো থেমে যাওয়া সাজে না। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নিজের আত্মবিশ্বাস অটুট রেখে সংগীতচর্চা অব্যাহত রাখেন। শাকিরার গানের সঙ্গে সখ্য অবশ্য একেবারে অল্প বয়সেই। মাত্র চার বছরেই! চার বছরের ছোট্ট মেয়েটিই আস্ত একটা কবিতা লিখে ফেলেন, গালভরা একটা নামও দেন—লা রোসা দো ক্রিস্টাল (বাংলায় ‘স্ফটিকের গোলাপ’)। বাবাকে টাইপরাইটারে প্রায়ই গল্প লিখতে দেখে তাঁর নিজের একটা টাইপরাইটারের খুব শখ জাগে। বড়দিনের উপহার হিসেবে তাই জামা-জুতোর বদলে একটি টাইপরাইটার চেয়ে বসেন ছোট্ট শাকিরা। অবশেষে সাত বছর বয়সে হাতে আসে স্বপ্নের উপহার, তখনই কবিতা আর গান লিখে হাত পাকানোর শুরু। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে আরবীয় সুর ও ঐতিহ্যবাহী এক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। সুরটি ছোট্ট শাকিরার এত ভালো লাগে যে উচ্ছ্বসিত হয়ে টেবিলের ওপর উঠে নাচতে থাকেন তিনি।
বাবাকে কালো চশমা পরে থাকতে দেখে আট বছর বয়সে শাকিরা ‘তোমার কালো চশমা’ নামে তাঁর প্রথম গান লিখে ফেলেন। এভাবে শৈশবেই সংগীতের ভুবনে পথচলা শুরু পৃথিবীজুড়ে সংগীতপিপাসু কোটি ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া গায়িকা শাকিরার।
ছোটবেলায় ক্যাথলিক স্কুলের শত নিয়মকানুনের মধ্যেও শাকিরার শিল্পচর্চা থেমে যায়নি। ক্লাসের সহপাঠীদের জন্য তো বটেই, শিক্ষকদের সামনেও তিনি গান গাইতেন। কিন্তু স্কুলের আনুষ্ঠানিক গানের দলে তাঁকে নেওয়া হয়নি কখনো। গানের দলের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বলেছিলেন যে শাকিরার গান শুনলে মনে হয় ‘ছাগল ভ্যঁা ভ্যঁা করছে’। এমন বিদ্রুপ আর সমালোচনার পরও তিনি দমে যাননি। গান-নাচ দুটোই পুরোদমে নিজের চেষ্টায় চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রতি শুক্রবারে স্কুলের সবার সামনে এ সপ্তাহে শেখা নতুন নাচের মুদ্রা পরিবেশন করতেন শাকিরা। তখন থেকেই তাঁর স্বপ্ন শিল্পী হওয়ার। বয়স ১০ হতে না-হতেই এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি।
কিন্তু স্বপ্ন আর প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও বাধ সাধে ভাগ্য। বাবার দেউলিয়া অবস্থায় পুরো পরিবারের সঙ্গে শিশু শাকিরার সময়ও কাটছিল চরম হতাশায়। এ সময় তাঁর বাবা তাঁকে একটি পার্কে বেড়াতে নিয়ে যান, যাতে তিনি বুঝতে পারেন, অনেকের অবস্থা তাঁদের চেয়েও খারাপ। সেদিন পার্কে গিয়ে অনাথ, নিরাশ্রয় শিশুদের দেখতে দেখতে তাঁর হতাশা পরিণত হলো সংকল্পে। ‘পার্কে আমার বয়সী এমনকি আমার চেয়েও ছোট ছেলেমেয়েরা খালি পায়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের কারও বাবা-মা ছিল না, থাকার জায়গাও ছিল না। এই বয়সেই তারা নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল। এসব দেখে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম নিজের দুর্দশা তো কাটিয়ে উঠবই, কোনো দিন যদি বড় শিল্পী হতে পারি তবে এমন শিশুদের সাহায্যের জন্য সাধ্যমতো কাজ করব।’ প্রতিজ্ঞা করেন শাকিরা।
নিজের সেই প্রতিজ্ঞা সফলভাবেই রাখতে পেরেছেন শাকিরা। আজ সংগীতজগতের সবচেয়ে ধনী ও সফল তারকাদের অন্যতম তিনি। শুধু অর্থের দিক থেকেই নয়, অসাধারণ সংগীতে কোটি কোটি মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছেন তিনি। সমাজসচেতন এই শিল্পী জড়িত রয়েছেন সেবামূলক কাজের সঙ্গেও। নিজের দেশে তিনি শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন পিএজ দেস্কালজস্ ফাউন্ডেশন। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে ‘প্রেসিডেন্টস অ্যাডভাইসরি কমিশন অন এডুকেশনাল এক্সেলেন্স ফর হিস্পানিকস’-এর একজন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন। ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।
সূত্র: ২০০৯ সালে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে দেওয়া শাকিরার সাক্ষাৎকার ও তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট অবলম্বনে
0 comments:
Post a Comment