Md. Afrooz Zaman Khan

Afrooz
Md. Afrooz Zaman Khan. Powered by Blogger.
RSS

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর




ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
আবুল মোমেন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
৬৫ পৃষ্ঠা
দাম: ১৫০ টাকা।
ব্যক্তির কীর্তি ও মহত্ত্ব সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে তাঁর প্রকৃত নামটি চাপা পড়ে যায়, উপাধির আলোকচ্ছটায়। বাঙালি সমাজেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে এমন নজির সত্য ও প্রমাণিত, যদিও আজকের দিনে তা বিরলও। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামের মানুষটি যেমন মহৎ ও বিদ্যান, উদার মনের নমস্য বাঙালিও। তাঁর নাম কে না জানে! তাঁর প্রকৃত নাম যে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধির আড়ালে সেটি ঢাকা পড়ে গেছে। ‘বিদ্যাসাগর’ আদতে সেকালের একটি উপাধি, নির্দিষ্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পাওয়া যেত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্বান ও বিদ্যা বিতরণে নিবেদিত মানুষ হিসেবে এমনই খ্যাতিমান হয়েছেন যে এই উপাধি তাঁরই একচেটিয়া হয়ে উঠেছে। তিনি ছাড়া, আর দ্বিতীয় কোনো বিদ্যাসাগর উপাধিধারীর কথা শোনা যায় না। তাঁর প্রয়াণের সোয়া শ বছর পরেও এই পরিচয়টিই যথার্থ।

এই বই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। সরল জীবনীটুকুই নয়, তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব গড়ে নিয়ে সমাজ ও কালকে অতিক্রম করে মনন-নৈতিকতা-ওজস্বিতা এবং নেতৃত্বে তিনি কীভাবে কালজ হয়ে উঠলেন, সবকিছুর সুনিপুণ আর তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ পাওয়া যাবে এতে।

বিদ্যাসাগরের জীবন কেটেছে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে। দারিদ্র্য ও শোষণ বাঙালির সমাজজীবনকে ক্ষয় করে ফেলেছিল। শিক্ষা, ইংরেজ শাসন ও সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অনেকেই বাংলার নবজাগরণে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন শহুরে বণিক পরিবারের। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সাত ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।

জীবনী রচনার প্রকরণে এখন বদল ঘটেছে। বংশপরিচয়, বাল্যজীবন, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবনের গড্ডলিকা এড়িয়ে তাই এই বইটির লেখক আবুল মোমেন বেছে নিয়েছেন সুন্দরতর এক ভঙ্গি। বলা যেতে পারে, প্রায় আত্মজীবনীর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি বিদ্যাসাগরকে তুলে ধরেছেন, বিচার করেছেন দেশকালের পরিমণ্ডলে। সমগ্র জীবনের কথাই এতে উঠে এসেছে তথ্যপূর্ণ ও ইতিহাস-সমর্থিতভাবে। কিন্তু তথ্যের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েনি কখনো। এই অভিনব কারণেই আনন্দময় পাঠানুভূতির ভেতর দিয়ে বইটি একবৈঠকে পড়ে ওঠা যায়।

বিদ্যাসাগর, সমকালে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি নিন্দুকদের উৎপীড়ন আর প্রতিরোধে কম অতিষ্ঠ হননি। কিন্তু তবু, মেধা ও পাণ্ডিত্যের সমন্বয়ে মানবিক গুণাবলির অতুলনীয় উদাহরণ তিনি। শিক্ষা-সমাজ সংস্কার এবং নেতৃত্বেও। এমন দৃঢ়চেতা, সাহসী ও মানবিক মানুষ অত্যন্ত বিরল। ফলে তাঁর জীবন ও ভাবনাসমুচ্চয় সময়-সমাজকে ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের চিরকালীন সম্পদ।

লেখক আবুল মোমেন আড্ডা বা মঞ্চে যেভাবে আটপৌরে ভাষায় কথা বলেন, এই বই লেখার ক্ষেত্রেও বহাল রেখেছেন সেই ভাষাটিই। এ গ্রন্থের বয়নকৌশল মুগ্ধকর।

‘কীর্তিমান বাঙালি’ সিরিজের এই বইয়ে বিদ্যাসাগরের জীবনকে দূর থেকে নয়, যেন বা খুব কাছ থেকে বৈচিত্র্যময়ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। এর মাধ্যমে গ্রন্থকারের অনুসন্ধিৎসু ও সংবেদী মানসব্যাপ্তি টের পাওয়া যায়, মনের প্রসারতাটুকুও।
তৎকালীন সমাজে বিদ্যাসাগরের গুরুত্ব কেমন ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য থেকে সেটি অনুধাবন করা যায়, ‘তিনি বিজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ, দেশহিতৈষী এবং সুলেখক, ইহা আমরা বিস্মৃত হই নাই। বঙ্গদেশ তাঁহার নিকট অনেক ঋণে বদ্ধ। এ কথা যদি আমরা বিস্মৃত হই, তবে আমরা কৃতঘ্ন।’

কিন্তু দু শতক আগে, অনগ্রসর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগে একজন বিদ্যাসাগর যে মানবিক-সামাজিক-নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করলেন, স্বচেষ্টায় দেশকালকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলেন অতুলনীয় ও কীর্তিমান—পুরো ব্যাপারটি ভাবলে বিস্ময় জাগে! আমাদের প্রযুক্তির ঝলমলে সময়ে, এখন বিদ্যাসাগরীয় দূরে থাকুক, তাঁর ছায়াতুল্য ব্যক্তিত্বের গড়ে ওঠাটুকুও দুর্লভ হয়ে পড়েছে। ও শুধু বইয়ে লেখা গল্প। রূপকথা। এই সমাজ ও সময়ে যথেষ্ট মননশীল, চিন্তাশীল, মুক্তমনের মানবিক, তাত্ত্বিক মানুষ কেন তৈরি হচ্ছে না! ভাবি, ভাবনাটুকু দীর্ঘশ্বাস হয়ে  ফিরে আসে।




  • Digg
  • Del.icio.us
  • StumbleUpon
  • Reddit
  • RSS

0 comments:

Post a Comment