ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
আবুল মোমেন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
৬৫ পৃষ্ঠা
দাম: ১৫০ টাকা।
আবুল মোমেন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
৬৫ পৃষ্ঠা
দাম: ১৫০ টাকা।
এই বই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। সরল জীবনীটুকুই নয়,
তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব গড়ে নিয়ে সমাজ ও কালকে
অতিক্রম করে মনন-নৈতিকতা-ওজস্বিতা এবং নেতৃত্বে তিনি কীভাবে কালজ হয়ে
উঠলেন, সবকিছুর সুনিপুণ আর তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ পাওয়া যাবে এতে।
বিদ্যাসাগরের জীবন কেটেছে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ
ক্রান্তিকালে। দারিদ্র্য ও শোষণ বাঙালির সমাজজীবনকে ক্ষয় করে ফেলেছিল।
শিক্ষা, ইংরেজ শাসন ও সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহন রায় থেকে
শুরু করে অনেকেই বাংলার নবজাগরণে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের
প্রত্যেকেই ছিলেন শহুরে বণিক পরিবারের। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন
বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সাত ভাই আর তিন
বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।
জীবনী রচনার প্রকরণে এখন বদল ঘটেছে। বংশপরিচয়, বাল্যজীবন,
শিক্ষাজীবন, কর্মজীবনের গড্ডলিকা এড়িয়ে তাই এই বইটির লেখক আবুল মোমেন
বেছে নিয়েছেন সুন্দরতর এক ভঙ্গি। বলা যেতে পারে, প্রায় আত্মজীবনীর
পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি বিদ্যাসাগরকে তুলে ধরেছেন, বিচার করেছেন দেশকালের
পরিমণ্ডলে। সমগ্র জীবনের কথাই এতে উঠে এসেছে তথ্যপূর্ণ ও
ইতিহাস-সমর্থিতভাবে। কিন্তু তথ্যের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েনি কখনো। এই
অভিনব কারণেই আনন্দময় পাঠানুভূতির ভেতর দিয়ে বইটি একবৈঠকে পড়ে ওঠা যায়।
বিদ্যাসাগর, সমকালে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ছিলেন,
তেমনি নিন্দুকদের উৎপীড়ন আর প্রতিরোধে কম অতিষ্ঠ হননি। কিন্তু তবু, মেধা ও
পাণ্ডিত্যের সমন্বয়ে মানবিক গুণাবলির অতুলনীয় উদাহরণ তিনি। শিক্ষা-সমাজ
সংস্কার এবং নেতৃত্বেও। এমন দৃঢ়চেতা, সাহসী ও মানবিক মানুষ অত্যন্ত বিরল।
ফলে তাঁর জীবন ও ভাবনাসমুচ্চয় সময়-সমাজকে ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের চিরকালীন
সম্পদ।
লেখক আবুল মোমেন আড্ডা বা মঞ্চে যেভাবে আটপৌরে ভাষায় কথা
বলেন, এই বই লেখার ক্ষেত্রেও বহাল রেখেছেন সেই ভাষাটিই। এ গ্রন্থের
বয়নকৌশল মুগ্ধকর।
‘কীর্তিমান বাঙালি’ সিরিজের এই বইয়ে বিদ্যাসাগরের জীবনকে
দূর থেকে নয়, যেন বা খুব কাছ থেকে বৈচিত্র্যময়ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। এর
মাধ্যমে গ্রন্থকারের অনুসন্ধিৎসু ও সংবেদী মানসব্যাপ্তি টের পাওয়া যায়,
মনের প্রসারতাটুকুও।
তৎকালীন সমাজে বিদ্যাসাগরের গুরুত্ব কেমন ছিল বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য থেকে সেটি অনুধাবন করা যায়, ‘তিনি বিজ্ঞ,
শাস্ত্রজ্ঞ, দেশহিতৈষী এবং সুলেখক, ইহা আমরা বিস্মৃত হই নাই। বঙ্গদেশ
তাঁহার নিকট অনেক ঋণে বদ্ধ। এ কথা যদি আমরা বিস্মৃত হই, তবে আমরা কৃতঘ্ন।’
কিন্তু দু শতক আগে, অনগ্রসর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগে একজন
বিদ্যাসাগর যে মানবিক-সামাজিক-নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করলেন, স্বচেষ্টায়
দেশকালকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলেন অতুলনীয় ও কীর্তিমান—পুরো ব্যাপারটি ভাবলে
বিস্ময় জাগে! আমাদের প্রযুক্তির ঝলমলে সময়ে, এখন বিদ্যাসাগরীয় দূরে থাকুক,
তাঁর ছায়াতুল্য ব্যক্তিত্বের গড়ে ওঠাটুকুও দুর্লভ হয়ে পড়েছে। ও শুধু বইয়ে
লেখা গল্প। রূপকথা। এই সমাজ ও সময়ে যথেষ্ট মননশীল, চিন্তাশীল, মুক্তমনের
মানবিক, তাত্ত্বিক মানুষ কেন তৈরি হচ্ছে না! ভাবি, ভাবনাটুকু দীর্ঘশ্বাস
হয়ে ফিরে আসে।
0 comments:
Post a Comment