পোশাক ও খেলার সরঞ্জাম নির্মাতা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান নাইকি ইনকরপোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফিল নাইট। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৩৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তিনি পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী। ক্যানসার গবেষণা ও বাস্কেটবল খেলার উন্নয়নে তিনি আর্থিক অনুদান প্রদানের জন্য আলোচিত। ফিল নাইট ২০১৪ সালের ১৪ জুন স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে এই বক্তৃতা করেন।
আমাকে আসলে আজকে এখানে কেন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আমি জানি না। আমাদের সময়টা আর তোমাদের সময়টা তো বেশ আলাদা। কিন্তু আমি আজকে আমার জীবনের কিছু কথা তোমাদের জানাতে চাই। যদিও আমি জনসম্মুখে কথা বলতে অভ্যস্ত নই, কিন্তু তারপরও আমি আজ এখানে এসেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তো জন্ম আমার। জন্মস্থানে ফিরে আসার আনন্দ নিশ্চয়ই অনেক ভালো লাগার। এই ক্যাম্পাসে আমি ২২ বছর বয়সে প্রথম পা রাখি। জড়তা, অনিশ্চিত আর লক্ষ্যহীন ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করি আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আর দ্বিতীয় বর্ষের মধ্যবর্তী গ্রীষ্মে আমি নিজের সঙ্গে দীর্ঘ এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। কর্মজীবনে প্রবেশের আগে আমি সারা পৃথিবী ঘুরে দেখব কি না—এই প্রশ্নে আমি নিজের সঙ্গে অনেক দিন তর্ক করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য, নিজেকে আলোকিত করার জন্য, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি পৃথিবী ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিই। ঠিক তারপরের শীতকালে আমি উদ্যোগবিষয়ক একটি কোর্স অংশ নিই। পড়াশোনার অংশ হিসেবে দুই সপ্তাহ মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থাকার সুযোগ পাই। প্রশিক্ষণ শেষে বাড়ি ফিরে আমি যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের পারিবারিক গাড়ি বিক্রি করে আমি টাকা জোগাড় করি। বন্ধু গ্যারি কার্টারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি পুরো যুক্তরাষ্ট্র দেখতে।
আমরা প্রথমে যাই হাওয়াইয়ে। আট ঘণ্টার বিমানযাত্রা শেষে হাওয়াই আসি আমরা। আমরা দুই বন্ধু সারা দিন হাওয়াইয়ে সমুদ্রে সার্ফিং করতাম। আর সন্ধ্যার কিছু আগে বাড়ি বাড়ি ঘুরে এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি করতাম। মনে হয়, আমিই স্ট্যানফোর্ডের একমাত্র স্নাতক শিক্ষার্থী, যার জীবনের প্রথম চাকরি ছিল ‘এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি’ করা। কয়েক মাস হাওয়াই থেকে বাড়ি ফিরব কি ফিরব না, সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যাই।
আমি জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। জাপান থেকে জুতা কেনার অর্ডার দিয়ে আমি হংকং চলে যাই। দেশে ফিরে ব্যবসা শুরুর আগে আমি নিজেকে চেনার চেষ্টায় অনেক মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করি। আমি অনেক জায়গায় যাই, অনেক অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা করি। জীবনে আসলে সে-ই বড় হয়, যার অভিজ্ঞতা যত বেশি। অভিজ্ঞতাই মূলধন।
বছর খানেক পরে দেশে ফিরে জাপান থেকে আনা জুতা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচ বিলি বাওয়ারম্যানকে দেখাই। আমরা অর্ধেক লভ্যাংশ ভাগের শর্তে জুতা বিক্রি শুরু করি। আমি আরও ৩০০ জুতার অর্ডার করি। প্রথম বছরে আমরা আট হাজার ডলারের জুতা বিক্রি করি। আমাদের এতে লাভ হয় ২৫০ ডলার। আমি ও কোচ মিলে একটা ছোট কোম্পানি গঠন করি। আমরা এক লাখ ডলারের জুতা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৭২ সালের মধ্যে আমরা দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের জুতা বিক্রি করে ফেলি। আমি নিজের ব্র্যান্ডের জুতা বিক্রির চেষ্টা করি। আমাদের ছোট কোম্পানিতে তত দিনে ৪৫ জন কর্মী কাজ শুরু করেছে। আমি সবাইকে নতুন ব্র্যান্ডের নাম দিতে বলি। স্ট্যানফোর্ডের এক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী জেফ জনসন ছিল আমাদের প্রথম কর্মী। সে-ই প্রথম ‘নাইকি’ নাম প্রস্তাব করে। আমার আসলে নামটি প্রথমে ভালো লাগেনি। কিন্তু বাকি ৪৪টি নামের চেয়ে এই নামটি ভালো ছিল বলে আমরা নাইকি নামের ব্র্যান্ডের জুতা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। আমরা শুধু দৌড়ানোর জুতা নয়, রেসলিংয়ের জুতা, টেনিসের জুতা, এমনকি বাস্কেটবল খেলার জুতা বিক্রি শুরু করি। আমাদের ওই বছর বিক্রি ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু সেবার আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস বিভাগ থেকে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কর প্রদান করার আদেশ জারি হয়। আসলে ভেবে পাচ্ছিলাম না এত টাকা কীভাবে জোগাড় করব।
আমাদের ১৫ হাজার জোড়া জুতা তৈরি হয়, এমন একটি কারখানা ছিল। আমরা কম লাভে জুতা বিক্রির ঘোষণা দিই। আমরা জাপান থেকে আনা জুতার অনুকরণে জুতা বিক্রি শুরু করি। আমাদের কাজ দেখে তখন অনেকেই হেসেছিল। কিন্তু আমরা থেমে থাকিনি। সবার হাসি থামানোর জন্যই আমরা দিন-রাত পরিশ্রম শুরু করে কর প্রদান করি।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৎবাঁধা বক্তৃতা পছন্দ করি না। আমি পরামর্শেও বিশ্বাসী না। অভিজ্ঞতা দিয়েই আমাদের শেখার পাল্লা ভারী করতে হবে। কাজ করার সামর্থ্য আর কাজ করার ইচ্ছা—সব টাকাপয়সা আর ক্ষমতাকে পরাজিত করতে পারে। তোমার যদি কোনো অর্থও না থাকে, তাহলে বাড়ি থেকে সাত হাজার মাইল দূরে যেতে ভয় পেয়ো না। কাজের সুযোগ পেলে তা ছেড়ে দিয়ো না। সুযোগ পেলেই নিজের প্রতিভা ঝালিয়ে নিতে পারো। আসলে যেখানে সংগ্রাম আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে আসলে দক্ষতা দেখানোর কিছু নেই।
১০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাও? এমন প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে মাঠে নেমে যাও। শুরু করাটাই আসল কাজ। আসলে আমাদের হাতে এত ভাবার সময় নেই। নিজেকে ভবিষ্যতে না দেখে বর্তমানে দেখার চেষ্টা করো। সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটা মন্ত্র আমাদের আত্মস্থ করা উচিত। আমার শিক্ষক ফ্র্যাঙ্ক শ্যালেনবার্জার ছয় দশক আগে বলেছিলেন, ‘তখনই তুমি ব্যর্থ হবে, যখনই তুমি চেষ্টা করবে না। অতএব, চেষ্টা করে যাও।’
সূত্র: ওয়েবসাইট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
0 comments:
Post a Comment