এ পি জে আবদুল কালাম ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানী। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ ছাড়াও ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত। টেকফেস্ট আইআইটিতে ৪ জানুয়ারি ২০১৫ তিনি এই বক্তৃতা দেন।
যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষ বিভিন্ন দেশের মধ্যে অনেক সহজে যাওয়া-আসা করতে পারছে। এর ফলে দক্ষতা ও প্রতিভার বিশ্বায়ন ঘটেছে। আইডিয়া ও উদ্ভাবন আর ভৌগোলিক বা রাজনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধ নেই। আজকের একটি আবিষ্কারের হাজার মাইল দূরে বাজার খুঁজে পেতে এতটুকুও দেরি হয় না। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বৈশ্বিক জ্ঞানের সূচনা করেছে, যেখানে পৃথিবীর এক প্রান্তের সমস্যা সমাধানে একাধিক বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন স্থানে বসেই একসঙ্গে কাজ করতে পারেন।
আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি ভারত থেকে একটি বিমানে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলাম। জানতে পারলাম, সেই বিমানটির নিয়ন্ত্রণের অধিকাংশ সফটওয়্যারই ভারতে তৈরি হয়েছে। আমি যখন আমার ক্রেডিট কার্ড বের করলাম, জানলাম, সেটির লেনদেনের পেছনের কাজগুলো চলছে মরিশাসের কোনো একটি সার্ভারে। আমি যখন বেঙ্গালুরুর একটি বহুজাতিক সফটওয়্যার কোম্পানিতে গেলাম, সেখানে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম এক চীনা ডেভেলপার, এক কোরিয়ান প্রজেক্ট লিডার, এক ভারতীয় প্রকৌশলী, এক আমেরিকান হার্ডওয়্যার প্রকৌশলী এবং এক জার্মান যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ—সবাই মিলে অস্ট্রেলিয়ার কোনো একটি ব্যাংকের সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। তাঁরা যে সংস্কৃতি থেকেই আসুন বা যে ভাষায়ই কথা বলুন না কেন, সবাইকে একটি পরিবারের মতো একসঙ্গে দেখে আমার মনে হলো, এই বন্ধন যাতে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো সীমান্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করা।
পৃথিবীর নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে আমার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০৩০ সালে পৃথিবীর চেহারা কেমন হবে, আমি তার একটি রূপকল্প তৈরি করেছি।
সেটি এমন একটি পৃথিবী হবে যেখানে—
সেটি এমন একটি পৃথিবী হবে যেখানে—
১. গ্রাম ও শহর, ধনী ও গরিব, উন্নত ও উন্নয়নশীলের পার্থক্য কমে আসবে।
২. জ্বালানি ও সুপেয় পানির সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে এবং তা মানুষের হাতের নাগালে আসবে।
৩. প্রতিটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো চিহ্নিত হবে এবং সে অনুসারে যৌথ মিশনে কাজ করার মাধ্যমে সবার অর্থনৈতিক সুবিধা ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৪. শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষা গ্রহণ করবে, যা তাদের মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলবে।
৫. সবার জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। ৬. স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
৭. নারী ও শিশুদের ওপর সব ধরনের অন্যায়ের অবসান ঘটবে এবং সমাজে অবহেলিত বলে কেউ থাকবে না।
৮. প্রত্যেক নাগরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস করতে পারবে।
৯. সব দেশ সন্ত্রাসবাদের ভয়ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
১০. সৃজনশীল নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব অনতিবিলম্বে দূর করে বিশ্বকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটির বেশি মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, আজ আমি তাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে বলতে চাই।
গ্রামের জনগণের প্রতিভা এক বিশাল সম্ভাবনাময় সম্পদ, যা এখনো কাজে লাগানো হয়নি। শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোতেও আমি শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান লক্ষ করেছি। ২০১০ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকিতে ছিলাম, সেখানে পূর্ব কেন্টাকির গ্রামগুলো আর্থসামাজিক দিক থেকে কতটা পিছিয়ে আছে, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি, সেখানকার সরকার ও অন্যান্য সংস্থা মিলে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে অধিকাংশ জনগণ গ্রামাঞ্চলে বাস করে, তাই তাদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
এই ৩০০ কোটি মানুষের ক্ষমতায়নের বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ, যার চারটি দিক রয়েছে। প্রথমত, নতুন পণ্য ও সেবার সুবিধাভোগের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে ভারতের জনগণের মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ ৮০০ মার্কিন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার। অনুমান করা হয় যে উত্থানশীল অর্থনীতিগুলোর জনগণের মধ্যে ভোগের পরিমাণ এমনভাবে বাড়ছে যে ২০০৯ সালে জন্মগ্রহণকারী কোনো শিশু ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণকারী কোনো ব্যক্তির তুলনায় ৩৫ গুণ বেশি পণ্য ও সেবা ভোগ করছে। এর ফলে স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে মানানসই নতুন নতুন জিনিসপত্রের প্রয়োজন হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। শুধু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। ৩০০ কোটি মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য তাই স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম উদ্ভাবন প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, জ্বালানি ও শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করা। উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে শক্তির চাহিদা যে আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী শক্তির চাহিদা প্রায় ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্বালানি যেমন কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের সরবরাহ কমে আসবে। ফলে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন—নিউক্লিয়ার শক্তি, বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
তৃতীয়ত, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। এটি প্রমাণিত সত্য যে এখন উন্নত সমাজে জীবনযাপনের যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, তা গোটা পৃথিবীর পরিবেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যদি পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষ উন্নত সমাজের মানুষের মতো বসবাস করে, তাহলে যে পরিমাণ সম্পদ প্রয়োজন হবে, তার জোগান দিতে এবং উৎপাদিত বর্জ্য নিষ্কাশন করতে আরও ছয়টি পৃথিবীর দরকার পড়বে। তাই ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ওপর যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সেদিনে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
চতুর্থত, বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও সংঘর্ষের ইতি টানা। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতাসহ নানা কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীতে নানা দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বেড়েই চলেছে। এর ফলে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় হচ্ছে, তেমন অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৩০০ ব্যক্তির হাতে যে সম্পদ রয়েছে, তা সবচেয়ে দরিদ্র ৩০০ কোটি মানুষের সম্মিলিত সম্পদের তুলনায় বেশি। সবার জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাতের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আজকের তরুণদের মধ্যে এই মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে: ‘আমি পারব, আমরা পারব এবং আমাদের জাতি পারবে’। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের প্রত্যেক তরুণের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি জাগিয়ে তুলতে হবে এবং তাদের আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই পৃথিবীর ৩০০ কোটি মানুষের জীবনে টেকসই উন্নয়নের সুফল বয়ে আনা সম্ভব হবে।
সূত্র: এ পি জে আবদুল কালামের নিজস্ব ওয়েবসাইট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত, অনুবাদ
0 comments:
Post a Comment