টাইটানিক চলচ্চিত্রের জন্য বিশ্বব্যাপী আলোচিত ব্রিটিশ অভিনেত্রী কেট উইন্সলেট। জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৭৫ সালের ৫ অক্টোবর। নান্দনিক অভিনয়ের জন্য একাডেমিক পুরস্কার, এমি পুরস্কার, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার আর গ্র্যামি পুরস্কার জয় করেছেন তিনি।
আমি কেট উইন্সলেট। বছর ত্রিশেক আগেও আমি কেট উইন্সলেটই ছিলাম, কিন্তু সেই কেট ছিল দুর্বল আর নেতিবাচক মানসিকতার এক কিশোরী। আমার ছোটবেলা ছিল ভীষণ একঘেয়ে। ঘড়ির কাঁটার মধ্যে আটকে থাকত আমার জীবন। আমি নিজের দুনিয়ার বাইরে আসার স্বপ্ন দেখতাম। বয়স যখন ১৭, তখন ঘরের বাইরে আসার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন বুঝি, আমার সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। আমার বয়স ২১ পেরোনোর আগেই আমি হেভেনলি ক্রিয়েচার্স, সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি এবং টাইটানিক-এর মতো সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পাই। তখন থেকেই সময়কে উপভোগ করা শিখি। সবকিছু থেকে শেখার চেষ্টা করতাম, সেই চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি। নিজের শক্তি বাড়াতে অনেক রাত জেগে বই পড়তাম।
ছোটবেলায় আমাকে স্কুলে সবাই ‘মোটা’ বলে তিরস্কার করত। আমরা মানুষের পরিশ্রমকে মূল্য দিতে পছন্দ করি না। ‘মোটা’ বলে অবজ্ঞা করা কখনোই ঠিক নয়। কিন্তু যারা এসব বলে, তাদের থামানো যায় না। তাই কাজের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করাই সবচেয়ে সহজ উপায়। যারা আমাকে কটু কথা শোনাত, তারা আজ কোথায়?
যখন প্রথম সিনেমার দুনিয়ায় আসি, আমাকে অনেকেই নাম বদলাতে বলেছিল। এই নাম দিয়ে কিছু হবে না বলেছিল। আমি নাম বদলাইনি। চেয়েছিলাম কাজ দিয়ে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করতে।
পাঁচ-পাঁচবার একাডেমিক পুরস্কারে নাম মনোনীত হওয়ার পর আমার ঝুলিতে পুরস্কারটি জমা হয়। আমার জন্য এই পুরস্কার ছিল অনেক দিনের প্রতীক্ষার ফল। সমালোচকদের প্রশ্নের জবাব ছিল আমার অস্কার জয়। আমি সমালোচকদের সমালোচনা পড়ি না। নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। অন্যরা আমাকে নিয়ে কী ভাবল, তা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। সমালোচনা নিজের ওপর নিলে কাজেরই ক্ষতি হয়। আমি এসব সমালোচনা আর কটু কথা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলি। এসব আমার কাছে মূল্যহীন।
আমি আমাকে নিয়ে খুশি। মোটা হই কিংবা দেখতে খারাপ হই, তা কোনো কাজে আসবে না। বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বই আমার শক্তি। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে বুদ্ধি দিয়েই লড়তে হয়। আমার প্রশংসাও আমি সহ্য করতে পারি না। আমাকে সবাই সুন্দর আর রূপসী ভাবে, আমি আসলে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার একজন সাধারণ নারী। খুব নামী এক পরিচালক আমাকে এই সময়কার সবচেয়ে আধুনিক অভিনেত্রী বলে প্রশংসা করেছিলেন। আমি তাঁর কথা মোটেই বিশ্বাস করিনি। যদি বিশ্বাস করতাম, তাহলে সেদিনই কাজ বন্ধ করে দিতাম। নিজের প্রশংসা শোনা সত্যিই বিব্রতকর কাজ। প্রশংসায় গা ভাসালে চলবে না। আমাদের শরীরের সৌন্দর্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্যের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমি সিনেমায় কখনোই নিজেকে বেশি সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করি না। আমি জানি, আমাকে বিশ্বের অনেক কিশোরী অনুকরণ করে। আমি তাদের কথা ভেবে ওজন কমানোর চিন্তা করি না। আমি আমার মতো পর্দার সামনে হাজির হই। আমাকে অনেকে প্রায়ই মোটা, চিকন, বিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত নারীসহ অনেক নামে ডেকেছে। সব মনে রেখেছি, কিন্তু কাউকে কিছু বলিনি। কাজ করে দাঁতভাঙা জবাব দিতে চেয়েছিলাম।
স্বভাবত আমি একজন ইতিবাচক মানুষ। নিজেকে নিয়ে খুশি। আমার জীবন আর কাজ নিয়ে আমি আনন্দিত। আমার কাজ একটাই, মানুষকে স্বপ্ন দেখানো। সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করি। জীবনে হতাশা বলে কিছু নেই। জীবন অনেক রঙিন ভাবলেই দুঃখ আর হতাশা কাটে।
আমরা জীবনের বেশির ভাগ সময় দুঃখ করে পার করে দিই। আমার এই নেই, সেই নেই বলে আক্ষেপের মধ্য দিয়ে দিন কাটানোর চেষ্টা করি। হতাশা মানসিক রোগ। হতাশ না হয়ে কাজ না করলে জীবনকে এগিয়ে নেওয়া যায় না। কাজ ঠিক হচ্ছে না ভুল হচ্ছে, সেটা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। কাজ করার অভিজ্ঞতাই আমাদের হাড় শক্ত করে। নিজের স্বপ্নকে যে জয় করতে পারার শক্তি রাখে, ভবিষ্যৎ সময় তাকেই মনে রাখে। আমাদের প্রত্যেকের এই মুহূর্তের কথা ভেবে পা বাড়ানো উচিত। ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। বর্তমানই বলে দেয় আমরা কোথায় যাব।
আমাদের একটাই জীবন। দুশ্চিন্তা করে জীবন পার করে দেয় বোকারা আর চিন্তা করে সময় উপভোগ করে বুদ্ধিমানেরা। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাসিমুখে সূর্যকে হ্যালো বলে দিন শুরু করা উচিত আমাদের। আনন্দ নিয়ে সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহ রাখতে হবে নিজের মধ্যে।
আমি অনুকরণ করাকে উৎসাহ দিই না। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে অনেক ম্যাগাজিন আসত, আমি ম্যাগাজিনের ছবির মতো চুল আর পোশাক পরার স্টাইল অনুকরণ করতাম। অনুকরণ করলে নিজের মধ্যে হতাশা জন্মে। তরুণদের বলি, কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণ নয়, নিজের মতো চলো। নিজের মতো চলার মধ্যে যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
সূত্র: ওয়েবসাইট। বিবিসিতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার অবলম্বনে