
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী টিভি ব্যক্তিত্ব অপরাহ্ উইনফ্রে। টানা ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ‘দ্য অপরাহ্ উইনফ্রে শো’ সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেছেন তিনি। গত ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন সি. স্মিথ ইউনিভার্সিটির ১৪৪তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তা ছিলেন এই উপস্থাপক।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে মানুষ বলে, ‘আমি রোমাঞ্চিত। আনন্দিত।’ আজকে আমার অনুভূতিটা তার চেয়েও বেশি কিছু। কেন? বলছি।
২০০২ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার (মাদিবা) বাড়ির অতিথি হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রায় ১০ দিন সেখানে ছিলাম। সে সময় একবার মাদিবার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল, কী করলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর হতে পারে। বিশেষ করে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দারিদ্র্য মুছে ফেলতে হলে কী করণীয়, সেটাই তিনি জানতে চাইছিলেন। আমি বললাম, আমার মনে হয়, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একমাত্র শক্তি হতে পারে শিক্ষা। সঙ্গে এ-ও জানালাম, আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় মেয়েদের জন্য একটা স্কুল করতে চাই।
তিনি আমাকে পথ বাতলে দিলেন। আমার স্কুল গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো। আমি মেয়েদের সেই স্বপ্ন, সেই আশাটা দিতে চেয়েছিলাম, যেটা একদিন আমি পেয়েছি। আমি মেয়েদের একটা সুযোগ দিতে চেয়েছি। কারণ তুমি কাউকে যত বড় সুযোগ দেবে, তার কাছে তোমার প্রত্যাশাটাও তত বড় হবে। টাকা দিয়ে তুমি কারও জীবন বদলাতে পারবে না। শিক্ষার মাধ্যমে বরং তুমি কাউকে সেই সুযোগটা করে দিতে পারো, যেন সে নিজেই নিজের জীবন বদলাতে পারে।
অতএব, কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আমি খুঁজতে শুরু করলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার কোন মেয়েদের মাঝে ‘একটা কিছু’ আছে। নয়টা প্রদেশ ঘুরে আমি নিজে প্রায় পাঁচ শর বেশি মেয়ের সাক্ষাৎকার নিলাম, সেই ‘একটা কিছু’র খোঁজে। কী সেটা? ব্যাপারটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এভাবে বলা যায়, ‘যা-ই হোক না কেন, আমি পারব’। এই আত্মবিশ্বাস আর জেদটাই আমরা মেয়েদের চোখে খুঁজছিলাম। এমন কাউকে খুঁজছিলাম, যে নিজের ভাগ্য বদলাবে, পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে।
আজ দেখো। সেই স্কুলের (অপরাহ্ উইনফ্রে লিডারশিপ একাডেমি ফর গার্লস) তিনটি মেয়ে তোমাদের ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। তিনজনের মধ্যে দুজন, যাদের আমি আমার মেয়ে বলি, আজ তোমাদের সঙ্গে স্নাতকের টুপি মাথায় দিয়ে বসে আছে! তাই কোনো কিছুই আমাকে আজ এখানে আসা থেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আজ মনে হচ্ছে, মাদিবার কাছে যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম, সেটা রাখতে পেরেছি। আমি ভীষণ খুশি।
আমার মা-বাবার বিয়ে হয়নি। এমনকি তাঁরা মাত্র একবার মিলিত হয়েছিলেন। সুতরাং আমার জন্ম হোক সেটা কেউ চায়নি। এমনকি আমার মা-ও তাঁর মাতৃত্বের লক্ষণ লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। লোকে আমাকে ‘পিতৃপরিচয়হীন’ বলত। বুঝতেই পারছ, ১৯৫৪ সালের মিসিসিপিতে এই শব্দটা কতখানি লজ্জা বহন করত। জন্মের পর অনেকটা সময় এই লজ্জা আমাকে ঘিরে রেখেছিল। যখন আমার বয়স চার কি পাঁচ, তখন প্রথম ভেতর থেকে একটা অন্য রকম ডাক শুনতে পেলাম। এমন এক মিসিসিপিতে আমি বড় হয়েছি, যেখানে বিদ্যুৎ, পানি, টেলিভিশন কিছুই ছিল না। একদিন আমার নানি রোদে কাপড় দিচ্ছিলেন। আমি বারান্দায় বসে খেলছিলাম আর নানির কাজ দেখছিলাম। নানি বললেন, ‘আমাকে দেখে শেখো। একদিন তোমাকেও করতে হবে।’ সেদিনই প্রথম আমার ভেতর কে যেন বলে উঠল, ‘উঁহু, আমি তো তোমার মতো হব না!’ আমি বলেছি, আমার বয়স মাত্র চার কি পাঁচ। সে বয়সেই কেন যেন মনে হচ্ছিল, জীবনে আরও বড় কিছু করার আছে। হওয়ার .আছে। আজ পর্যন্ত ভেতরের সেই কণ্ঠস্বরটাই আমাকে এত দূর এনেছে। আমি তোমাদেরও এই উপদেশই দেব, হৃদয়ের ডাকে সাড়া দাও। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে এমন একটা কণ্ঠস্বর আছে, যেটা তাকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বলে। যদি আর সবাই ভুল কাজটাও করে, তুমি অন্যের কথা না শুনে নিজের ভেতরের সেই কণ্ঠস্বরটা শোনো।
0 comments:
Post a Comment