
ফোনটা একটানা বাজছে। একটা মুভি দেখছিলাম। বিরক্তি নিয়ে ফোনটি ধরলাম।
হ্যালো।
—কে বলছেন? ওপাশ থেকে মিষ্টি এক নারী কণ্ঠ ভেসে এল।
আগে বলুন, আপনি কে বলছেন?
—প্রশ্নটি আমি আগে করেছি। নারী কণ্ঠের উত্তর।
তো কি হয়েছে। ফোনতো আপনি করেছেন। আপনি কাকে ফোন করেছেন, জানেন না? একটু রাগী গলায় উত্তর দিলাম।
—আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? নারী কণ্ঠ বলল।
লাইনটা কেটে দিলাম। আজাইরা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্লে বাটনে চাপ দিয়ে মুভি দেখা শুরু করতেই আবার ফোন বেজে উঠল।
হ্যালো।
—আপনি তো চরম ছোটলোক। লাইন কাটলেন কেন? আবার সেই নারী কণ্ঠ।
ভদ্রভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলুন।
—আপনি কি ভদ্রলোক যে আপনার সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। অভদ্র, ছোটলোক।
রাগটাকে বহু কষ্টে দমন করলাম। কোনো কড়া কথা না বলে লাইনটা আবার কেটে দিলাম। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে আবার ফোন। ফোনটি রিসিভ করলাম কিন্তু কোনো কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।
আবার সেই নারী কণ্ঠ, প্লিজ লাইনটা কাটবেন না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
আপনিই বলছেন আমি অভদ্র, ছোটলোক। তাহলে বারবার ফোন করছেন কেন? বললাম আমি।
—সরি। আসলে আমার মাথা ঠিক নাই। তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছি, কিছু মনে করবেন না।
ওকে কিছু মনে করলাম না। এখন বলুন আপনি কে এবং কাকে চাচ্ছেন?
—আমার নাম কবিতা। আর আমি আসলে জানি না আমি কাকে চাচ্ছি।
মানে কি? বুঝলাম না।
—আসলে আমার মনটা খারাপ। খুব খারাপ। ভাবলাম কারও সাথে কথা বলি, তাহলে হয়তো ভালো লাগবে। তাই আপনাকে ফোন করেছি।
আমি কবিতা নামে কাউকে চিনি না। আপনি আমার ফোন নম্বর পেলেন কি করে?
—আমি বিভিন্ন সংখ্যা দিয়ে সাতটি ফোন নম্বর বানিয়েছি। তারপর লটারি করে তিনটি নম্বর নির্বাচন করেছি। ওই তিনটি নম্বরের দ্বিতীয়টা আপনার নম্বর।
তা প্রথম নম্বরে ফোন না করে আমাকে কেন?
—প্রথম নম্বরে করেছিলাম। কেউ ধরেনি। তাই আপনাকে করলাম। আপনি না ধরলে পরের নম্বরে করতাম।
ভেরি গুড। মনে করেন আমিও ধরিনি। পরেরটাকে ট্রাই করুন।
—আপনিতো ধরেছেন। আমি কেন ওই রকম ভাবতে যাব।
কারণ আমি অপরিচিত কারও সাথে কথা বলি না।
—হ্যালো,আপনি কি ভেবেছেন আমি মলম পার্টির সদস্য?
আমি কি করে জানব আপনি কে? আর তা ছাড়া আমি একটু ব্যস্ত আছি। আমি ফোনটা রাখতে যাচ্ছি।
—প্লিজ লাইনটা কাটবেন না। আমি আমার জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্ত আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।
শেষ মুহূর্ত মানে? বুঝলাম না।
—আপনার সাথে কথা বলা শেষ করে আমি আত্মহত্যা করব।
ভেরি গুড। সিদ্ধান্ত কি ফাইনাল?
—হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
তাহলে দেরি করা ঠিক হবে না। এখন বেলা ১২টা। আপনি তাড়াতাড়ি আত্মহত্যার কাজটা সেরে ফেলুন। আপনি যত দ্রুত শুভ কাজটা শেষ করবেন, ততই আপনার আপনজনদের উপকার হবে।
—আপনি কি ফাজলামি করছেন? আমি কিন্তু সিরিয়াস।
আমিও সিরিয়াস। কারণ দিনের আলো থাকতে থাকতেই দাফন কাফন শেষ করতে হলে আপনার আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
—এত তাড়াতাড়ি দাফন করতে হবে কেন? কাল বা পরশু করবে।
আমার তা মনে হয় না। আপনার এখন যতটা মূল্য আছে সবার কাছে, সেটা আপনার মৃত্যুর পর থাকবে বলে মনে হয় না। আসলে কারও বেলাই থাকে না। লাশকে কেউ ঘরে বেশিক্ষণ রাখতে চায় না।
—আমার বাবা-মা আমাকে খুব ভালোবাসে। তারা এমন করবে না।
আপনার ধারণা ভুল। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, আপনার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করুন। তার ওপর আপনি আবার আত্মহত্যা করছেন। হতে পারে আপনার বাবা-মা লোক লজ্জার ভয়ে হয়তো আত্মীয়স্বজনদেরও খবর দেবে না। চুপি চুপি দ্রুত দাফন শেষ করে ফেলবে। এনিওয়ে গুডলাক। হ্যাপি আত্মহত্যা। আমি এখন ফোনটি রাখব। আমি একটা মুভি দেখছিলাম। খুবই মজার একটা কমেডি মুভি। আপনার সাথে কথা বলার কারণে আমি মুভিটি শেষ করতে পারছি না।
—আপনি কি মানুষ!
আমিতো তাই জানি। কেন বলুন তো।
—একটা মেয়ে মারা যাচ্ছে সেটার কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? আপনার কাছে মুভি দেখাটাই বড় হলো! একবার জানতেও চাইলেন না, আমি কেন আত্মহত্যা করছি।
আমি কখনো কাউকে আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করি না। আপনার ইচ্ছে হলে আপনি বলতে পারেন। তবে যা বলবেন সংক্ষেপে। কারণ বউ শপিংয়ে গেছে। যে কোনো সময় চলে আসতে পারে। এসে যদি দেখে আমি কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছি আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন বা আত্মহত্যার সুযোগও দেবে না। সরাসরি খুন করে ফেলবে। সেই খুন করতে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে সেটা বলা মুশকিল। তবে সেটা যে কষ্টদায়ক হবে সেটা নিশ্চিত।
আসলে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তাই বউয়ের ভয় দেখিয়ে ফোনটা রাখতে চাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে আমি ব্যাচেলর।
নারী কণ্ঠ বলল, আপনি আপনার স্ত্রীকে এত ভয় পান?
সব বুদ্ধিমান স্বামীই স্ত্রীকে ভয় পায়। আমার কথা বাদ দেন। আপনার কথা তাড়াতাড়ি শেষ করেন।
—আমার বয়ফ্রেন্ড আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর সাথে প্রেম করছে। যেটা আমি মানতে পারছি না। গতকাল ঘটনাটা জানার পর থেকেই কান্না করছি। কাল সারা রাত আমি কেঁদেছি। আর কান্না করতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখন আত্মহত্যা করব। আমি মারা গেলে ও বুঝবে আমি কি ছিলাম। তবে বাবা-মার জন্য কষ্ট লাগছে। আমি তাদের একমাত্র সন্তান।
আপনার কাহিনিটা আমার পছন্দ হয়েছে। ভাবছি একটা গল্প লিখব। কিন্তু আপনি যদি আত্মহত্যা না করেন তাহলে গল্পটা জমবে না। তাই আপনাকে অবশ্যই আত্মহত্যা করতে হবে। আমি গল্পটা পত্রিকায় পাঠাব। যদি তারা ছাপায় তাহলে মরেও আপনি ভাগ্যবতী। কারণ আপনি রাতারাতি ফেমাস হয়ে যাবেন।
—আপনি আমার সাথে ফাজলামি করছেন। ঠিক না?
জি, ঠিক।
—কিন্তু কেন?
আপনার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে আপনার বয়স ষোলোর বেশি হবে না।
—আমার বয়স ১৫।
আপনার বয়ফ্রেন্ড, সরি এক্স বয়ফ্রেন্ড খুবই বুদ্ধিমান। সে বুঝতে পেরেছে আপনি একটা গাধা টাইপ মেয়ে। গাধা টাইপ মেয়েদের একটা সময় পর বিরক্তিকর মনে হয়। তাই সে আগেভাগেই কেটে পড়েছে। বাদ দেন এসব ভেবে এখন আর কোনো লাভ নেই। অতএব সময় নষ্ট না করে আত্মহত্যার কাজটি দ্রুত সেরে ফেলুন।
—কোথায় আপনি আমাকে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করবেন, তা না। বারবার আমাকে আত্মহত্যার কথা বলছেন, কেন?
বারবার আত্মহত্যার কথা বলছি, কারণ দুনিয়ায় গাধার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। দু-একটা কমলে তো ভালোই হয়।
—আপনি আমাকে গাধা বলছেন কেন? আপনি জানেন আমি কত ভালো স্টুডেন্ট?
না, জানি না। তবে আপনি যে মস্ত বড় একটা গাধা, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আর আপনি শুধু গাধাই নন, আপনি একজন বড় মাপের বেইমানও। মীরজাফরের নাম শুনেছেন? আপনি হচ্ছেন একজন মহিলা মীরজাফর।
—মানে কি? খারাপ ব্যবহার করছেন কেন?
আমি মোটেও খারাপ ব্যবহার করছি না। গাধা বলছি কারণ আপনি একজন প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের জন্য আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন। যে হয়তো কখনই আপনাকে ভালোবাসেনি। আর বেইমান বলছি এই কারণে, যে বাবা-মা আপনাকে এত ভালোবাসা এবং আদর যত্ন দিয়ে বড় করেছে, তাদের কথা না ভেবেই আত্মহত্যার করতে যাচ্ছেন। অথচ আপনি তাদের একমাত্র অবলম্বন।
—তাহলে কি আপনি আমাকে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করছেন?
না তা করছি না। আমি কারও পেটে লাথি মারতে চাই না।
—মানে কি?
দেখুন মাটির নিচে যে সব পোকা মাকড় আছে, তারা অপেক্ষায় আছে কখন আপনাকে পাবে। আরাম করে খাবে। এখন যদি আপনি আত্মহত্যা না করেন তবে তাদের পেটে লাথি মারা হবে। সেটা কি ঠিক হবে?
—ইস! আমার গা ঘিনঘিন করছে, বমি আসছে। ওমা আমিতো এগুলো ভাবিনি। আত্মহত্যা ক্যানসেল।
সেটা কি ঠিক হবে। আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ডের জন্য খারাপ লাগবে না?
—না এখন আর খারাপ লাগছে না। তবে রাগ হচ্ছে হারামজাদার ওপর। বলেন তো কি করা যায়?
রাগ কমার জন্য একটা কাজ করতে পারেন। আপনার বয়ফ্রেন্ড এখন যার সঙ্গে প্রেম করছে মানে আপনার বান্ধবীর সামনে বয়ফ্রেন্ডকে কষে থাপ্পড় মারবেন। তারপর আপনার বান্ধবীর হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বলবেন, গো টু হেল। পারবেন না?
—অবশ্যই পারব। প্ল্যানটা আমার পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা থাপ্পড় কি একটা দেব?
না। মিনিমাম দুইটা।
—দুই গালে দুইটা দিব না এক গালে দুইটা দিব?
গণনার কি দরকার। যতক্ষণ ভালো লাগে মারবেন।
—থাপ্পড় মারব ভাবতেই মনটা হালকা লাগছে। আচ্ছা এখন যেয়ে মেরে আসি।
তা যাওয়া যায়। তবে পরে মারলেও সমস্যা নাই। কিন্তু থাপ্পড়টা মারতে হবে আপনার বান্ধবীর সামনে।
—অবশ্যই। বান্ধবীর সামনেই মারব। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আচ্ছা আপনি কি আসলেই বিবাহিত?
শুনুন আমি কি সেটা ইমপর্টেন্ট না। আর যেহেতু আত্মহত্যা ক্যানসেল সেহেতু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। আমি এখন ফোন রাখব। আমাকে মুভিটি শেষ করতে হবে।
—আমি কি আপনার ফেসবুক আইডিটা পেতে পারি, প্লিজ। একটা করুণ আবদারের সুর নারী কণ্ঠে।
না, পারেন না। আর শুনুন আজকের পর আমাকে আর ফোন করবেন না। শুধু আমি না অপরিচিত কারও সাথেই কথা বলবেন না। এটা নিরাপদ না। আল্লাহ হাফেজ।
কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইনটা কেটে দিলাম। আবার ফোন বাজছে। এই মেয়েতো ভীষণ জ্বালাতন করছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের পাওয়ার অফ করে দিলাম। যাতে আর ফোন না করতে পারে। কারণ আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অনেক কাজ। বুয়া আসেনি রান্না করতে হবে। ব্যাচেলর জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট রান্না করা। একটা বউ থাকলে মন্দ হতো না।
বি. দ্র. জীবন একটাই ও সেটা অনেক মূল্যবান। একে যার তার কারণে নষ্ট করা উচিত না। অন্যকে ভালোবাসার আগে নিজেকে ভালোবাসুন। জীবনটাকে উপভোগ করুন। পৃথিবীটা অনেক অনেক অনেক সুন্দর।